নিজেকে প্রচারের জন্য মানুষ কত কিছুই না করে! আবার অনেকে নির্বোধের মতো না বুঝেই অন্যের কথামতো কাজ করে! আসুন জেনে নিই তেমন কিছু বিষয় যেসবের কোনো ভিত্তি নেই, অথচ আমরা না বুঝেই তা করে থাকি!
একটি মেয়ের ছবি দিয়ে লিখে দেওয়া হলো, ‘এই হিজাবি বোনটির জন্য কতগুলো লাইক হবে? সবাই লিখুন মাশাআল্লাহ'। সেই ছবিতে ‘মাশাআল্লাহ’ লেখা কমেন্টের ধুম পড়ে গেল। শেয়ারের ঝড়ে ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক কমিউনিটিজুড়ে। এ নিয়ে ধর্মবিরাগী অনলাইন এক্টিভিস্টরা হাসাহাসি করে মজাও নিচ্ছেন বেশ। উপহাসের পাত্র বানিয়ে দেওয়া হলো হিজাবকে।
‘আমিন না লিখে যাবেন না’; ‘মুসলমান হলে আমিন না লিখে যাবেন না’ ‘ছুবহানাল্লাহ, আল্লাহর কী কুদরত!’ ‘এটা নবীজির পাত্র, আমিন না লিখে যাবেন না’ –এ জাতীয় লেখার সঙ্গে পরিচিত নয়, এমন ফেইসবুক ব্যবহারকারী হয়তো পাওয়া যাবে না। নাস্তিকদের পেইজ ব্লগগুলোতে ভিজিট করলে দেখা যায় তারা কী রকম মজা লুটে নেয় এই জাতীয় লেখাগুলো থেকে।
‘আমিন না লিখে যাবেন না’ –এটি বর্তমানে সবচাইতে জনপ্রিয় পোষ্টগুলোর একটি! ব্যাপারটি এমন যেন, আপনি জান্নাতে যেতে চাইলে ঘরে বসে কমেন্টে আমিন লিখলেই টিকিট কনফার্ম! অসংখ্য পেইজে, গ্রুপে, ফেসবুকে ভরপুর হয়ে গেছে এই আমিন আমিন। এদের লাইক এক দুই হাজার নয়। এদের লাইক সংখ্যা বিশ/ ত্রিশ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত। বাংলাদেশের প্রায় লক্ষ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারী এদের পাল্লায় পড়ে ভুল পথে যাচ্ছে। এরা আবার অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষের দুর্বলতম দিক, আবেগকে। ইসলামকে ব্যবহার করে এই কাজটি করছে সুনিপুনভাবে।
মূলত লাইক কমেন্ট প্রত্যাশী অতি আবেগী কিছু মানুষ মনে করছে এটাই বুঝি ইসলামের প্রচার। এমন সব ভুয়া পোস্ট দেওয়াকে তারা বর্তমানে ফেসবুকে ‘ইসলাম প্রচার’ মনে করছেন। আর অন্য সরলপ্রাণ মুসলমানগণ লাইক-কমেন্টও করেছেন। অসুস্থ বা রুগ্ন শিশুর ছবি দিয়ে লিখে দেয়, ‘আমিন না লিখে যাবেন না'; ভাবখানা এমন যে, এখানে লাইক দিলেই জান্নাত। প্রশ্ন হলো, এখানে রুগ্ন ব্যক্তির সঙ্গে আমিন বলার কী সম্পর্ক? নবীজি (স) এর পাত্র বা জামার সঙ্গে আমিন বলার কী সম্পর্ক?
ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে ঝড় তোলা একটা দল আছে যাদের পোস্ট অনেকটা এই রকম- "আপনি কোনটি চান? কমেন্ট করুন', সেখানে একটি ফটোতে ডিভাইডার দিয়ে একপাশে টাকা পয়সা ও আরেকপাশে কুরআন এর ছবি আছে এবং অপশন দুটি '১' ও '২' দিয়ে ইনডিকেট করা আছে। আবার দেখা যায়, "যদি চান দেশে ইসলামী আইন চালু হোক 'আমিন/ হ্যা' লিখুন"।
এইসব আহাম্মকদের বলতে চাই, ফেসবুকের পোস্টে '১/২' কিংবা 'আমীন/ হ্যা' লিখলেই কি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে? আর 'আমীন' না লিখলেই কি ইসলাম ধুলোয় মিশে যাবে? এই ভণ্ডামি বন্ধ করেন। ধর্মবিশ্বাস একটি মনের বিষয় আর বাস্তব জীবনে তা মেনে চলার বিষয়, ফেসবুকে ঝড় তুলে বাস্তবে বসে থাকার বিষয় নয়।
আবার দেখা যায়, অমুক বিষয়টি দেশে কার্যকর হোক, এটি আপনি চান কি না 'হ্যা/ না' লিখুন। আরে তুই কে এমন যে তোর ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া পোস্টে কমেন্টের 'হ্যা/ না' এর পরিমাণ হিসাব করে সরকার সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কে তুই যে তোর এই পোস্ট দিয়ে তা বাস্তবায়ন হবে?
আর যে পন্থায় কাজ করলে তা বাস্তবায়ন হবে এইসব পোস্টদাতারা তার ধারের কাছেও যায় না, শুধু ফেসবুকে ঝড় তুলে বাস্তবে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।
আর সবচেয়ে আবাল তারা যারা আবার সেখানে কমেন্ট করে।
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, ২/৩ দিন গবেষনা করে কোরআন হাদীস ঘেঁটে একটা বিষয় নিয়ে পোষ্ট দিলে সারা দিনেও ৫০/৬০ লাইক উঠে না, কিন্তু এই জাতীয় পোষ্ট দেওয়ার ঘন্টা খানেক এর ভিতর হাজার হাজার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। দিন শেষে তা লাখ ছাড়িয়ে যায়। তাই লাইক-কমেন্ট প্রত্যাশী গ্রুপ এডমিন, পেইজ এডমিনরা এই জাতীয় পোষ্টকেই বেশী পছন্দ করে থাকে। এগুলোকেই বেশি বেশি প্রচার করে থাকেন।
আসলে লাইক-কমেন্ট পাওয়ার লোভ এক ধরনের মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা যেন লাইক-কমেন্টের কাঙাল। ফলে বেশি লাইক পেতে ধর্মীয় অনুভূতি আর গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, লাইক বা কমেন্ট কী মহামূল্যবান জিনিস যে মিথ্যা প্রচার করে লাইক বা কমেন্ট পেতেই হবে! কী উপকার হবে এতে? মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা প্রচারের মধ্যে দিয়ে অতি সাময়িক ফায়দা লাভ হলেও মূলত এরা দীর্ঘকালীন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। কারণ মিথ্যা ফাঁস হয়ে গেলে মিথ্যাবাদীর জন্য বয়ে আনে মারাত্মক লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- দুর্ভোগ প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপীর জন্য। (সুরা জাসিয়া ৭)।
আবার অনেক সময় পাশাপাশি কয়েকটি ধর্মীয় গ্রন্থের ছবি দিয়ে বলা হয়, ‘আপনি কোনটির সাপোর্টার?’ আবার কখনও দেখা যায়, হৃদয়ে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো প্রশ্ন, ‘আপনি কি মুসলমান?’ মুসলমান হলে লাইক না দিয়ে যাবেন না। আবেগী ফেসবুকাররা এখানে ধুমছে লাইক দিচ্ছেন। এগুলো ইসলাম নিয়ে ইসলামের পরিভাষা ‘আমিন’কে নিয়ে উপহাস করা ছাড়া কিছুই নয়। কখনো দেখা যায়, অশুদ্ধ বা জাল হাদিস তুলে ধরে বলা হয়, ‘লাইক দিন, যদি জান্নাতে যেতে চান'। অথচ মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করা যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেওয়া। রাসুলুল্লাহ (স) বলেন, 'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়' (বুখারি হা/৩৪৬১)।
এখনই সময় সচেতন হয়ে এ জাতীয় পোস্ট প্রচার ও প্রসার বন্ধ করার। তা না হলে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে অপেক্ষা করবে একটি অশিক্ষিত এবং ভুল ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজন্ম! যারা ইসলামের দাওয়াত বলতে এগুলোকেই বুঝবে। আর এক সময় নাস্তিকদের মতো তারাও হয়তো ধরে নেবে এটাই বুঝি ইসলাম এবং এটি অন্তঃসারশূন্য একটি ধর্ম!
সুতরাং, আসুন আজ হতে শপথ নেই যে, নাস্তিকদের জন্য নিজেদের ধর্মকে উপহাসের পাত্র বানাবো না। আমরা সত্যিকারে ইসলাম শিক্ষায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করি। কোন লাইক কমেন্টস বিজনেস না করে কোরআন ও হাদীসের বানীকেই কেবল প্রচার ও প্রসার করি। আশা করি এতেই আপনার ও সবার ইহকাল ও পরকালের মুক্তি অর্জিত হবে, ইনশাআল্লাহ!
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি-
কিছু কথা বলতে চাই আবাল নাদানদের উদ্দেশ্যে যারা মাথা খাটায় না, হুজুগেই নাচে। যখন ফেসবুক ছিল না তখন দেখা যেতো মিথ্যা কাহিনী লিখে কাগজে ছাপিয়ে বলা হতো দশ দিনের মাঝে নিজ টাকায় এই পরিমাণ কপি বিলি করলে এত দিনের মধ্যে এই এই পাওয়া যাবে, আর এই ঘটনা বিশ্বাস না করলে এই এই হবে এবং এটা প্রচার না করলে এই এই হবে। এটা ছিল ইহুদিদের চালবাজি। এতে করে তারা আমাদের ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল। জানতে চান কীভাবে? তাহলে ব্যাখ্যা করছি।
এতে দেখা যাবে যে, এই ভুয়া তথ্যকে বিশ্বাস করে সেই কাজ করার পরেও যখন তাদের লাইফে কোনো উন্নতি হবে না তখন প্রভুর উপর থেকে তাদের বিশ্বাস হারিয়ে যাবে; আর এভাবেই পাতানো ফাঁদের মাধ্যমে ইহুদিরা মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে নেমেছিল এবং মুসলিমরা না বুঝেই তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছিল।
এটা ছিল ইহুদিদের বিশেষ এক কৌশল; তারা ভালো করেই ঠাণ্ডা মাথায় আবিষ্কার করেছিল যে, নির্বোধ মুসলিমদেরকে একবার এটাতে জড়াতে পারলে তারা না বুঝেই এটা করতে থাকবে এবং এটা জ্যামিতিক হারে দ্রুত প্রসার লাভ করবে; ফলে ইসলাম ধর্ম একটি ভুয়া কাহিনীভিত্তিক লোকাচারে পরিণত হবে এবং ইসলামের আসল বিষয়বস্তু হারিয়ে যাবে, ফলে মানুষ হতাশ হয়ে ইসলাম ত্যাগ করবে।
এরপর যদিও এ বিষয়ে উলামা-মাসায়েখদের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে একই জিনিস দেখা যায় যখন বিভিন্ন সিম কোম্পানির SMS অফার আসে তখনও নির্বোধ মুসলিমরা একই কাজ SMS পদ্ধতিতে শুরু করে। সর্বশেষ ফেসবুকের যুগে আবারও নির্বোধ মুসলিমরা একই ফাঁদে পড়ে আবারো এই নির্বোধের কাজ শুরু করেছে।
সেখানে ছাপানো সেসব ঘটনার কোনো কুরআর বা হাদিসগত ভিত্তি নাই। যার কোনো কুরআন হাদিসগত ভিত্তি নাই তা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে পালন করলেই কোনো ফল পাওয়া সম্ভব নয়। আর দেখা যাবে যখনই কেউ মনের বিশ্বাস থেকে এসব ভিত্তিহীন কাজ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে করবে কিন্তু কোনো ভালো ফল পাবে না তখনই আল্লাহর উপর থেকে তার বিশ্বাস কমে যাবে; কিন্তু ত্রুটিটা আসলে কোথায় দেখুন- সে তো করেছেই ভিত্তিহীন কাজ। সে ভিত্তিহীন ভুয়া তথ্য প্রচার করবে আর আল্লাহ তাকে ভালো ফল দেবেন?
এটা ইহুদিদের একটি ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা যে, যেখানে মুসলিমদের অহেতুক সময় নষ্ট করে, তাদের অনেক প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে তাদের বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বিশ্বাসে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। দেখা যায় মুসলিমদের যেখানে অনেক সময়ই দোয়া কবুল হয় না- দোয়া কবুল না হওয়ার পেছনেও অনেক কারণ আছে, এবং সকল শর্ত মানার পরেও যেখানে দোয়া কবুল হয় না তার পেছনেও আবার আলাদা ইসলামিক ব্যাখ্যা আছে সেখানে ভুয়া কাজ অন্ধবিশ্বাস নিয়ে করে তা থেকে ফল পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
২০০৭ সালের দিকে একজনের প্রচার করা এরকম একটি ছাপানো কাগজ হাতে পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল এই কাগজ বিলি করে একজন ব্যবসার এত টাকা লাভ করেছে, একজন স্বপ্ন দেখে মাটি খুড়ে গুপ্তধন পেয়ে কোটিপতি হয়েছে, একজন লটারি জিতে লাখোপতি হয়েছে। সেদিনই খটকা লেগেছিল আমার; ইসলামে 'লটারি'ই তো হারাম, প্রভু তাকে পুরস্কার হিসেবে লটারি জিতিয়ে দেয় কী করে? প্রভুর দেওয়া সব পুরস্কারই তো পবিত্র হয়; কিন্তু লটারি তো পবিত্র নয়, লটারি তো হারাম।
সেই কাহিনী বিশ্বাস করে আমার এক স্কুলের ক্লাসমেট ১০০০ কপি বিলি করেছিল। সে এসএসসি পাশ করতে পারে নি, এখন ছেলের বাপ- এই আর কী! তাহলে কই সে পুরস্কার পেল?
তাই আসুন, এদের এসব ফাও পোস্টে লাইক/ কমেন্ট/ শেয়ার না দিয়ে এসব ভুয়াদের প্রতিরোধ করি।
(সম্পাদিত)
ভালো থাকুন | School of Awareness
No comments:
Post a Comment